বাংলাদেশের মাটি এবং উষ্ণ আর্দ্র জলবায়ু ফল উৎপাদনের উপযোগী । তেমনিভাবে নানা প্রকার রাগবালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রব্যের জন্যও অনুকূল । পোকামাকড় দমনের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হয় । তবে ঢালাও ভাবে পোকামাকড় ধ্বংস করা উচিত নয় । কেননা, ফল বা ফল গাছের অনষ্টিকারী পোকামাকড়ের সাথে অনেক উপকারী পোকাও থাকে । এরা ফুলের পরাগায়ণে সাহায্য করে এবং অনিষ্টকারী পোকামাকড়ের ডিম ও কীড়া খেয়ে অনেক উপকার করে থাকে ।
ফল বা ফলগাছে পোকামাকড় ও বালাই আক্রমণের পূর্বে সতর্কতামূলক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত । কেননা আক্রমণের পর দমন করা অপেক্ষা আগে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া অনেক ভাল । এ জন্য সময়মত জমিচাষ, আগাছা দমন, সুষম সার ব্যবহার, পানিসেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা করতে হয় । এছাড়া ভাল জাত নির্বাচন করে সঠিক সময় ও সঠিক স্থানে রোপণ করে সুস্থ গাছ জন্মাতে হবে । গাছ দৈহিকভাবে দুর্বল হলে নানা প্রকার পোকামাকড় ও বালাইয়ের আক্রমণ বেশি হতে পারে । পোকামাকড়ের আক্রমণের লক্ষণ ও কীটের উপস্থিতি বিভিন্নভাবে বোঝা যায় । যেমন- ফল ছিদ্রকরা, পাতা ফ্যাকাশে বা হলদে হয়ে যাওয়া, ফল বা পাতা খাওয়া, পাতা চিবানো, পাতা মাড়ানো, কাণ্ড বা শেকড় নষ্ট করা, গাছে সুড়ঙ্গ সৃষ্টিকারী পোকার মলের চিহ্ন দেখে বুঝতে পারা যায় ।
ফল ও ফল গাছের আক্রমণকারী প্রধান প্রধান পোকা
বাংলাদেশের প্রধান প্রধান ফলে ও ফল গাছে নানা ধরনের পোকা মাকড় আক্রমণ করে থাকে । নিম্নের সারণিতে ফল ও ফল গাছে আক্রমন কারী প্রধান প্রধান পোকামাকড়ের তালিকা দেয়া হলো ।
ফল ও ফল গাছের আক্রমণের ধরন দেখে পোকা শনাক্ত
ফল ও ফল গাছের অনিষ্টকারী পাকামাকড় দমন করতে হলে এর স্বভাব, প্রকৃতি, বিস্তৃতি, জীবন বৃত্তান্ত, আবির্ভাবের সময় ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন । নিম্নের বর্নিত ফলের প্রধান প্রধান পোকার আবির্ভাবের সময় ও ক্ষতির লক্ষণ দেখে শনাক্তকারী পোকার বাংলা ও ইংরেজি নাম দেয়া হলো ।
ক্র নং | অবির্ভাব্বে সময় | আক্রমণের ধরন/বতির লক্ষণ | শনাক্তকারী পোকার বাংলা ও ইরেজি নাম |
১ | জানুয়ারি - এপ্রিল ও জুন-জুলাই | বাচ্চা ও পূর্ণবয়ক অবস্থায় কচি পাতা ও ফুলের রস চুষে খায়। গাছ দুর্বল হয়, যথেষ্ট ফুল হওয়া সত্ত্বেও গুটি হওয়ার আগেই ফুল ঝরে পড়ে । | আমের হপার পোকা Mango hopper |
২ | এপ্রিল-মে | স্ত্রী পোকে কাঁচা আমের গায়ে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে ফলের শাঁসের মধ্যে আঁকা বাঁকা সুড়ঙ্গ তৈরি করে খেতে থাকে। প্রাপ্ত বয়স্ক উইভিলে পরিণত হয়ে আমের খোসা ছিদ্র করে বাইরে বের হয়ে যায় । | আম ফলের ভোমরা পোকা Mango fruit weevil |
৩ | মার্চ নভেম্বর | স্ত্রী পোকা আম গাছের কাণ্ড ও শাখায় গর্ত করে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীড়া বের হয়ে কাণ্ড বা শীখার মধ্যে সুড়ঙ্গ করে ঢোকে । আক্রান্ত শাখা সহজেই ভেঙ্গে যায়। চারা গাছের কাণ্ড আক্রান্ত হলে গাছ মারা যেতে পারে । | আম গাছের কাণ্ডের মাজর পোকা Mango stem borer |
৪ | মার্চ - নভেম্বর | বিছা পোকার কীড়া আম গাছের পাতা খেয়ে গাছকে পশুন্য করে দেয়। ফলে গাছে ফুল ও ফল আসে না। | আম পাতার বিছা পোকা Mango leaf gall midges |
৫ | এপ্রিল মে | কীড়া আমের ভেতর ঢুকে শাঁস খাওয়ার ফলে আম পঁচে যায়। আক্রান্ত ফল কাটলে তার মধ্যে অসংখ্য কীড়া কিলবিল করতে দেখা যায় | আমের মাছি পোকা Mango fruit fly |
৬ | মে - অক্টোবর | কাঁঠাল ছিদ্র করে ভেতর ঢুকে পচিয়ে ফেলে। | কাঁঠালের ফল ছিদ্রকারী পোকা Stone weevil |
৭ | এপ্রিল- আগষ্ট | পূর্ণ বয়স্ক বিটল কঁচি কলা পাতা ও কচি কলার খোসা খায়। ফলে কলার পাতা ও ফলের ওপর ছোট ছোট দাগের সৃষ্টি হয় । | কলার পাতা ও ফলের বিটল পোকা Banana leaf and fruit beetle |
৮ | জুলাই - অক্টোবর | পুর্ন বয়স্ক উইভিল কলা গাছের গোড়ায় শিকড়ের ওপর ডিম পাড়ে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে কাণ্ডের ভেতর ঢুকে যায়। ফলে আক্রান্ত অংশ পচে যায়, ডগার পাতা শুকিয়ে গাছ মরে যায়। | কলা গাছের কাণ্ডের শুড় পোকা Banana Stem weevil |
৯ | ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল | কীড়া ফসলের বোটার দিকে ছিদ্র করে ঢুকে শাঁস ও বীজ খায়। | লিচু ছিদ্রকারী পোকা Litchi fruit borer |
১০ | মার্চ - জুন এবং আগস্ট-অক্টোবর | ক্ষুদ্র মাকড় পাতার নিচে ছিদ্র করে রস শোষণ করে। ফলে আক্রান্ত পাতা কুঁকড়ে যায় ও শুকিয়ে ঝরে পড়ে । | লিচু পাতার ক্ষুদ্র মাকড় Litchi mite |
১১ | মে - অক্টোবর | পাতা থেকে রস চুষে খায় । | পেয়ারা সাদা মাছি whitefly |
১২ | মে - অক্টোবর | ফল ছিদ্র করে শাঁস খায়। | ফলের মাছি Fruit fly |
১৩ | জুন- সেপ্টেম্বর | ডগা, ফল, কুড়ি থেকে রস চুষে খায়, ফন্দ্রে আকার ছোট হয় । | ছাতরা পোকা Mealy bug |
১৪ | সারা বছর | নারিকেল গাছের মাথায় না বের হওয়া পাতা কেটে ক্ষতি করে । | নারিকেল গাছের গন্ডার বা গোবরে পোকা Rhinoceros beelle |
পোকা দমনের পদ্ধতি
ফসল জন্মানোর কালে প্রায়শ এগুলোকে কীট কিংবা রোগ দ্বারা আক্রান্ত হতে দেখা যায় । কীট কিংবা রোগ দমন করতে না পারলে ফসল বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় । ফসলের পোকামাকড় দমনে গৃহীত ব্যবস্থাগুলো কোন সময় অর্থাৎ ফসলের বৃদ্ধি ও পোকার আক্রমণের কোন স্তরে প্রয়োগ করা হবে তার উপর নির্ভর করে দমন পদ্ধতিকে দু ভাগে ভাগ করা হয়েছে । যথা- (ক) প্রাফোইল্যাক্সিস- পোকামাকড় যাতে গাছ বা ফলে আক্রমণ করতে না পারে সে জন্য পূর্বেই যে ব্যবস্থা নেয়া হয় তাকে প্রতিরোধক বা প্রিভেনটিভ ব্যবস্থা বলে । (খ) থেরাপি- আক্রান্ত গাছে পোকামাকড়ের আক্রমণ বৃদ্ধি ঠেকানারে জন্য বা দমনের জন্য যে ব্যবস্থা নেয়া হয় তাকে প্রতিষেধক বা কিউরেটিভ ব্যবস্থা বলে ।
গাছ সুস্থ ও সঠিকভাবে বেড়ে উঠার জন্য চারার যথাযথ যত্ন, জমি কর্ষণ, ও সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে । এর ফলে গাছের পোকামাকড় আক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মাবে । গাছ কখনো কখনো শারীরিকভাবে দুর্বল হতে পারে । এ সময় কোন কোন পোকামাকড় গাছে বা ফলে আক্রমণ করতে পারে । তাই গাছের অবস্থা দেখে পানি বা খাদ্য উপাদানের ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করে গাছকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে । তাতে গাছে পোকামাকড় আক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মাবে এবং গাছ শক্তিশালী হবে ।
গাছে পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতে দুটি দমন ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিরোধক বা প্রিভেনটিভ ব্যবস্থাকে প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণও বলা যেতে পারে । এ পদ্ধতিতে গাছে পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রাকৃতিক উপায়ে নিয়ন্ত্রিত হয় । এ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় । যেমন- ক) আবহাওয়াগত অবস্থার পরিবর্তন খ) জমির উঁচু নিচু অবস্থানগত অবস্থা গ) পরিবেশগতভাবে এক ধরনের পোকা দ্বারা অন্য ধরনের পোকা ধ্বংস হওয়া এবং ঘ) আশ্রয়দাতার নিকট হতে আক্রমণকারী পোকাকে বিচ্ছিন্ন করা ।
অপর দমন ব্যবস্থা যথা- প্রতিষেধক বা কিউরেটিভ ব্যবস্থাকে প্রয়োগিক নিয়ন্ত্রণ বলা যেতে পারে । এ পদ্ধতিতে গাছে পোকামাকড়ের আক্রমণ কৃত্রিম উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয় । এ পদ্ধতিকেও কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় । যেমন —
১। যান্ত্রিক দমন (Mechanical control)
২। জৈবিক দমন (Biological Control)
৩ । পরিচর্যামূলক দমন (Cultural Control)
৪ । পোকামাকড় প্রতিরোধী জাত (Use of resistant variety)
৫ । রাসায়নিক দমন (Chemical Control)
৬ । আইনগত দমন (Legal Control)
৭ । ভৌত দমন
যান্ত্রিক উপায়ে পোকা দমন পদ্ধতি ও উপকারিতা
পোকামাকড় দমনে প্রতিষেধক পদ্ধতির অন্তর্গত যান্ত্রিক পদ্ধতি সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো ।
১। যান্ত্রিক দমন পদ্ধতি
এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পোকামাকড় দমন করা যায়। যেমন- আলোর ফাদ, প্রতিরক্ষামূলক বাধা, জালি, ভৌতশক্তি, উত্তাপ অথবা শৈত্যের ব্যবহার, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি । যান্ত্রিক উপায়ে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ হলো বিশেষ ধরনের কোন যন্ত্র, মানুষের শ্রম ও কোন বিশেষ দ্রব্যের সাহায্যে কীটপতঙ্গ দমনের একটি কৌশল। কৌশলগতভাবে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ অর্থনৈতিক ভাবে সাধারণত লাভজনক হয়ে থাকে । কিন্তু এ পদ্ধতি ব্যবহার করে অধিক সংখ্যক কীটপতঙ্গ দমন করা সম্ভব হয় না, তবে এ পদ্ধতি পরিবেশ বান্ধব । যান্ত্রিক উপায়ে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলো নিচে আলোচনা করা হলো ।
(i) হাত দ্বারা আহরণ
যে সব পোকা ডিম গাদা করে পাড়ে এবং ডিম ফুটার পর শুককীট/কীড়া একত্রে গাদা করে অবস্থান করে সে সব পোকা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এ পদ্ধতি উত্তম। এ সব পোকার ডিম হাত দিয়ে সংগ্রহ করে মারা যায় । যেমন বেগুন, শিম, কাঁকরালে ও করলা গাছের পাতা হতে এপিল্যাকনা বিটলের ডিমের গাদা এবং বিটল হাত দ্বারা সংগ্রহ করে সহজেই মেরে ফেলা যায় । অথবা আক্রান্ত ডিমের গাদাসহ ডাল বা পাতা কাঁচি দিয়ে কেটে সংগ্রহ করে পিষে বা মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করা যায় ।
(ii) পোকা ধরার জাল ব্যবহার
আক্রান্ত ক্ষেতে পোকা ধরার জাল দ্বারা সুইপ করে ঝাড়া দিয়ে অনেক পোকা আটকানো যায় । পরে এ গুলোকে মাটিতে পুঁতে মেরে ফেলা যায়। যেমন- ধানের পামরী পোকা এ পদ্ধতির মাধ্যমে সহজেই দমন করা যায় ।
(iii) পিটিয়ে এবং খুঁচিয়ে
যে সকল পোকা খাদ্য দ্রব্য পেলে সেখানে দলে দলে ভিড় জমায় সে সকল পোকা মাকড় ঝাড়ু বা অন্যকোন বস্তু দ্বারা পিটিয়ে দমন করা যায়। যেমন- তেলাপোকা, পিঁপড়া ইত্যাদি। আবার কিছু পাকা আছে যারা পোষকের দেহে গর্ত করে বা ফাটলে লুকিয়ে থেকে ক্ষতি করে। এদেরকে লাহোর শিক দ্বারা খুঁচিয়ে মেরে ফেলা যায় যেমন নারিকেলের বিটল পোকা ।
(vi) ঝাঁকিয়ে (Shaking)
ছোট ছোট গাছে পোকা আক্রমণ করলে সেগুলো অনেক সময় কঁকিয়ে মাটিতে ফেলে মেরে ফেলা হয় । যেমন আমড়া, লিচু, কলা ইত্যাদি গাছের বিটল । গাছ কুপিয়ে মাটিতে ফেলে এ সমস্ত পোকা মেরে ফেলা যায় ।
(v) প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে
কীট পতঙ্গ যাতে কাঙ্খিত ফসলের সংস্পর্শে আসতে না পারে সে জন্য প্রতিকন্ধকতা বা বাধার সৃষ্টি করে ফসলকে রক্ষা করা যায়। যেমন পাটের বিছা পোকায় আক্রান্ত ক্ষেতের চার পাশে নালা করে সেখানে কীটনাশক মিশ্রিত পানি দিলে পোকা পার্শ্ববর্তী ক্ষেতে যেতে পারে না।
অনুরূপভাবে ডালিম, কুমড়া বা কলা কচি অবস্থায় কাপড়, চট বা । নিচের দিকে মুখ ভালো পলিথিন ব্যাগ দিয়ে ঢেকে দিলে এ ফসলগুলোর ফল যেমন- ডালিমের প্রজাপতি, ফলের মাছি পোকা এবং কলার বিটলের আক্রমণ হতে রক্ষা করা যায় ।
(vi) চালুন দ্বারা চেলে ও কুলা দ্বারা ঝেড়ে চেলে
গোলাজাত শস্যের কতগুলো পোকা এ পদ্ধতির মাধ্যমে দমন করা যায় । যেমন- ময়দার কেড়ী পোকা, চালনি দ্বারা চেলে এবং চালের কেড়ী পোকা কুলা দ্বারা ঝেড়ে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় ।
(vii) যান্ত্রিক ফাঁদ
ফাদের সাহায্যে শস্যের কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ একটি উত্তম পন্থা। কীট পতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কিছু যাত্রিক ফাদ আবিষকৃত হয়েছে যেমন- আলোর ফাঁদ, আঠা লাগানো ফঁদ ইত্যাদি । উজ্জ্বল আলোর নিচে বড় গামলা বা পাত্রে কীটনাশক মিশ্রিত বা সাবান মিশ্রিত পানি রেখে দিলে পোকা আলোতে আকৃষ্ট হয়ে উড়ে এসে পানিতে পড়ে মারা যায়, যেমন- ধানের মাজরা পোকার মথ, চুংগী পোকা, সবুজ পাতা ফড়িং ইত্যাদি। ছোট ছোট পোকা, যেমন ফলের মাছি পোকা, আঠা লাগানো ফাঁদের সাহায্যে আকৃষ্ট করে মারা যায় ।
যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পোকা দমনের উপকারীতা
১। দৈহিক উপায়ে পোকা দমনের ফলে অর্থাৎ কীটনাশকের পরিবর্তে হাত দিয়ে পোকা ধরে অথবা পাতার ডিমের গুচ্ছ হাত দিয়ে তুলে ধ্বংস করে, পোকামাকড়ের আশয়স্থল নষ্ট করে, আলোর ফাঁদ পেতে এবং পোকা খেকো পাখিকে জমিতে বসতে দেয়ার ব্যবস্থা করে পোকা দমন করলে পরিবেশ দূষণ রোধ হয় ।
২। কীট ও বালাই নাশকের মত ব্যবহার পরবর্তী পার্শ্বক্রিয়া না থাকায় পরিবেশ ও জীব বৈচিত্রের কোন ক্ষতি হয় না ।
৩। উপকারী পোকা মাকড় ও কীট পতঙ্গের সুরক্ষা হয় এবং জীব বৈচিত্র্য অক্ষুন্ন থাকে ।
৪ । কীট ও বালাই নাশকের ব্যবহার কমিয়ে আর্থিক সাশ্রয় করা যায় ।
৫। উপকারী পোকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় যেমন- মৌমাছি, মাকড়সা
পোকা দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার উপকারীতা
বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত মানের প্রচুর খাদ্য উৎপাদন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে । ফলে ব্যাপক রাসায়নিক দ্রব্য যেমন- সার ও বালাইনাশকের ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। এগুলো প্রয়োগের ফলে পোকা মাকড়ের জীবনচক্র এবং বংশবৃদ্ধিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে । শুধু তাই নয় লাগামহীন বালাই নাশক প্রয়োগের দরুন সকল প্রজাতির পোকা মাকড়সহ মানব দেহে দেখা দেয় বিভিন্ন রকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া । যারা এ সকল বালাই নাশক ক্ষেতে ও ফসলে ছড়াচ্ছে তারাতো এর শিকার হচ্ছেই তাছাড়া সাধারণ মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী দৈনন্দিন যে খাদ্য খাচ্ছে তার মধ্যে বালাই নাশকের অবশিষ্টাংশ হিসেবে তাদের দেহে এসব বিষ যাচেছ । এ বিপর্যয় শুধু আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার নামে কৃষিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যাদির যথেচ্ছ অপব্যবহারের ফলে ঘটে চলেছে । যদিও ফসলে বালাই বলতে ফসলের অনিষ্টকারী সকল প্রকার পোকা মাকড়, রোগ জীবানু আগাছা ও মেরুদন্ডী প্রাণী যা মানুষের স্বার্থে আঘাত হানে তাকে বোঝায়। বালাই দমনের জন্য বালাইনাশকের ওপর নির্ভর করার ফলে বহুবিধ সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে, যেমন- আগের তুলনায় পরবর্তী ফসলে পোকার আক্রমণ বৃদ্ধি, মানুষ ও পশু পাখির বিষক্রিয়াজনিত বিপদ, ফসলের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, পোকার প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও পরিবেশ দূমি করণ । এ সকল সমস্যা সমাধানের জন্য সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা একান্তভাবে দরকার ।
সাফলাজনকভাবে পোকা মাকড় দমন করতে হলে শুধু মাত্র বালাইনাশকের ওপর নির্ভর করে থাকলে চলবে না । বালাইনাশক প্রয়োগ ছাড়াও পোকা মাকড় দমনের অন্যান্য পদ্ধতিগুলো জানা এবং প্রয়োগ করা দরকার । সাধারনভাবে বলতে গেলে অল্প খরচে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের কোন ক্ষতি না করে যখন যে ব্যবস্থাটি প্রয়োজন তা প্রয়োগ করে ফসলের শুভ্র পোকামাকড়ের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করাকে পোকা মাকড় দমনের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) বলা হয়। অন্যভাবে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা হচ্ছে, রোগ ও পোকামাকড় সহ অনিষ্টকারী প্রানী ইত্যাদি বালাই দমনে ব্যবহার্য সকল দমন পদ্ধতিগুলোর মধ্যে বুদ্ধিমত্তার সাথে বিবেচনা করে সঠিক, সহজ ও কার্যকর পদ্ধতি নির্বাচন ও ব্যবহার নিশ্চিত করা । এতে করে নির্বাচিত এক বা একাধিক পদ্ধতি অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিবেশের দিক থেকে গ্রহন উপযোগী হয় । এ ব্যবস্থাপনা ফসলের বালাইকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয় যাতে করে তা কোনরূপ আর্থিক ক্ষতি করতে পারে। আর এ জন্যই বলা হয় যে, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার প্রধান উদ্দেশ্য হলো অধিক ফসল ফলানোর মাধ্যমে ভোক্তাদের জন্য কোনরূপ ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকবে । সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনার উপকারিতা নিচে দেয়া হলো ।
১। শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদন খরচ কমিয়ে দেয়।
২। প্রাকৃতিতে বিদ্যমান জৈবিক ভারসাম্য রক্ষা করতে সহায়তা করে ।
৩। বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যাদির ব্যবহার কম হওয়ায় পরিবেশ দূষণ মুক্ত থাকে ।
৪ । উপকারী পোকা মাকড়, মাছ, ব্যাঙ, পশুপাখি ইত্যাদি সংরক্ষণে সহায়তা করে
৫। অনিষ্টকারী কীটপতঙ্গ ও বালাইর সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত থাকে ।
৬। বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যদির যথেচ্ছ ব্যবহার কমিয়ে আনে।
৭। অনিষ্টকারী কীটপতঙ্গ ও ক্ষতিকারক বালাইসমূহ কীটনাশক ও বালাই নাশক সহনশীলতা প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করার সুযোগ পায় না ।
৮ । উপযুক্ত পরিবেশ ও প্রতিবেশ বজায় থাকে ।
২। জৈবিক দমন
এই পদ্ধতিতে পোকার প্রাকৃতিক শত্রু সমূহ যেমন- পরভোজী, পরজীবি এবং রোগজীবাণু কৃত্রিম উপায়ে বৃদ্ধি করে আক্রান্ত শস্য ক্ষেতে ছেড়ে দিয়ে দমন করা হয় । অনেক পোকা আছে যারা পরজীবি ও পরভোজী হিসেবে অন্য পোকা দমনে ব্যবহৃত হয় । রোগ জীবাণুর মধ্যে ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, কৃমি সফলভাবে জৈবিক দমনে ব্যবহৃত হয় ।
৩। পরিচর্যামূলক দমন
ফল বাগান ও শস্য ক্ষেতে নিয়মিত পরিচর্যার দ্বারা কীটপতঙ্গের ক্ষতি থেকে ফল ও ফসলকে মুক্ত রাখা সম্ভব । বিভিন্ন প্রকার পরিচর্যা যেমন- জমি কর্ষণ, আগাছা নিধন, শস্য বপন ও রোপণের তারিখ পরিবর্তন, বাগানে ও শস্য ক্ষেতে সেচ ও নিষ্কাশন, ফল গাছ ও শস্য ছাঁটাই, পরিমিত সার প্রয়োগ ইত্যাদি ।
৪। পোকা মাকড় প্রতিরোধীজাত ( Resistant variety)
পোকা প্রতিরোধীজাত ব্যবহার, কীটমুক্ত চারার ব্যবহার ইত্যাদি পদ্ধতিতে পোকা দমন করা যায় ।
৫। রাসায়নিক দমন
বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক দ্রব্যাদির মাধ্যমে কীটপতঙ্গ দমন করা হয়। এ সব দ্রব্যাদির মধ্যে কীটনাশক, আকর্ষক, বিকর্ষক, হরমোন ও খাদ্য নিরোধক উল্লেখযোগ্য ।
রাসায়নিক দমনের জন্য কীট নাশককে আবার বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায় । যেমন—
১। রাসায়নিক গঠনের উপর ভিত্তি করে ।
২। কীট পতঙ্গ বা গাছের মধ্যে কীটনাশকের কার্য প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে এবং
৩ । কীট পতঙ্গ বা গাছের মধ্যে ঔষধের প্রবেশ প্রণালির ওপর ভিত্তি করে ।
তবে কীট নাশকের ক্রিয়া এবং প্রবেশ প্রণালীর ওপর ভিত্তি করে কীট নাশককে ৫টি ভাগে ভাগ করা যায়
। (ক) পাকস্থলীর বিষ (খ) স্পর্শ বিষ (গ) অন্তর্বাহী বিষ (ঘ) ধুপন বিষ এবং (ঙ) বিতাড়ণকারী বিষ
আকর্ষকের মধ্যে ফেরামোন কৃত্রিমভাবে তৈরি করে পুরুষ পোকাকে আকৃষ্ট করে মারা যায় । বিকর্ষক কীট পতঙ্গকে নিরুৎসাহ, এড়িয়ে চলার প্রবণতা, অনাগ্রাসন ইত্যাদির মাধ্যমে দুরে সরিয়ে রাখে। হরমোন কীট পতঙ্গ দমনের আধুনিক পদ্ধতি । কৃত্রিম হরমোন যেমন- এলটুসিড, ডিমিলিন আক্রান্ত ক্ষেতে ছড়িয়ে দিলে কীট পতঙ্গ সরাসরি মরে না, কিন্তু বৃদ্ধি ব্যাহত হয় । সেই সাথে বিকলাঙ্গ, স্বল্পায়ু প্রজনন ক্ষমতা রহিত করে দমন কর যায় । খাদ্য নিরোধক, কীট পতঙ্গকে স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণে বিরত রাখে ।
৬। আইনগত দমন
কোন ক্ষতিকর পোকা কোন দেশ বা অঞ্চলে যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য আইনগত ভাবে বাধা প্ৰদান করা হয় । আক্রান্ত গাছের অংশ ও বীজ এক দেশ থেকে অন্য দেশ বা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে চলাচলে আইনগত বিধিনিষেধ আরোপ করে অনেক পোকা ও রোগের ব্যাপক বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা হয় । এই দমন পদ্ধতিকে কোয়ারেন্টাইন দমন পদ্ধতি বলে । বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যেমন সামুদ্রিক বন্দর, আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ও সীমান্ত এলাকায় পোকা দমনের জন্য আইনগত ব্যবস্থা আছে । সারা বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের গাছ বা বীজ বা চারা আনা নেয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইন আছে।
৭। ভৌত দমন
অধিক তাপমাত্রা প্রয়োগ করে, যেমন: গুদামে ১০-১২ ঘন্টা ৫০° সে তাপমাত্রা প্রয়োগ করলে, অন্য দিকে আক্রান্ত শস্য দানাকে প্রখর রোেদ শুকালে, অনেক ক্ষতিকর পোকা মারা যায় । অধিক ঠান্ডা যেমন: গুদাম ঘর ৫-১০° সে. তাপমাত্রায় কয়েক ঘণ্টা রেখে দিলে অনেক শস্য দানার ক্ষতিকর পোকা দমন হয় ।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। আম ফলের প্রধান পোকা কোনটি ।
২। পোকা দমন পদ্ধতিগুলোকে কত ভাগে ভাগ করা যায় ?
৩ । গাছে ও ফলে পোকার আক্রমণ সচরাচর কখন ঘটে থাকে ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১ । আমের প্রধান অনিষ্টকারী পোকাগুলোর নাম লেখ । আম ছিদ্রকারী পোকার ক্ষতির ধরন বর্ণনা কর ।
২। কলার পাতা ও ফলের বিটলের বৈজ্ঞানিক নাম কী ।
৩ । যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পোকা দমনের কৌশলগুলোর নাম লেখ ।
৪ । রাসায়নিকভাবে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের উপায়গুলো লিপিবদ্ধ কর ।
৫ । ফল ও ফল গাছের পোকা দমনে আইপিএম পদ্ধতি গ্রহণ করলে কীভাবে লাভবান হওয়া যায় ব্যাখ্যা কর ।
৬ । ফল ও ফল গাছে আক্রমণের ক্ষতির চিহ্ন দেখে কিভাবে পোকা সনাক্ত করা যায় ?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। ফল ও ফল গাছের আক্রমণকারী প্রধান প্রধান পোকার নাম ও বৈজ্ঞানিক নাম লেখ ।
২ । আম, লিচু ও নারিকেলের প্রত্যেকটির ৩টি পোকার নাম, তাদের ক্ষতির লক্ষণ ও প্রতিকার বর্ণনা কর ।
৩ । পোকা দমন পদ্ধতিগুলোর নাম উল্লেখ পূর্বক যে কোন একটি পদ্ধতির বিবরণ দাও ।
৪ । যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পোকা দমনের সুবিধা অসুবিধা এবং উপকারিতা বর্ণনা কর ।
৫ । আইপিএম বলতে কি বোঝায় । ফল ও ফল গাছে পোকা দমনে আইপিএম পদ্ধতির গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর
আরও দেখুন...